মাথার কাটা দাগ আর হাতে ট্যাটু; ১৪ বছর আগে হারিয়ে হাওয়া বাবাকে ফিরে পেলো ছেলে। যেন সিনেমার গল্প।
সারেঙ্গা, বাঁকুড়াঃ- সমাজ মাধ্যম, মাথার কাটা দাগ আর হাতের ট্যাটো যে একটা পরিবারে খুশির হাওয়া বইয়ে দেবে তা হয়তো জীবনে কেউ কখনো ভাবেন না। প্রায় ১৪ বছর নিখোঁজ থাকার পর নিজের ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিলে দিল সমাজ মাধ্যম, বাড়ি ফিরলেন সারেঙ্গার বামনীশোল গ্রামের বাসিন্দা সোমনাথ মন্ডল। সোমনাথ বাবুর বাড়িতে আসাটা যেন অনেক টা সিনেমার গল্পের মতো। আর এই গল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সমাজ মাধ্যম, রেলের কর্মীরা এবং বাঁকুড়ার সিমলাপাল ও সারেঙ্গা ব্লকের কয়েকজন যুবক। পুরুলিয়ার নিমতাড়া গ্রামের বাসিন্দা, প্রণব মাঝি, যার শ্বশুর বাড়ি বাঁকুড়ার সিমলাপালে। তিনি মধ্য প্রদেশের গঞ্জোবাসদা স্টেশনে কর্মরত।
বাঁকুড়ার সারেঙ্গা ব্লকের বামনীশোল গ্রামের বাসিন্দা সোমনাথ মন্ডল মানসিক ভারসাম্যহীন। আজ থেকে প্রায় ১৪ বছর আগে বাড়ি থেকে হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যান সোমনাথ মন্ডল। তারপর পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি ও করেন , কিন্তু খোঁজ মেলেনি। মনের মধ্যে প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়ার আশা হয় তো ছিল ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ ১৪ বছরে তা হয়তো ধীরে ধীরে কমে আসছিল পরিবারের সদস্যদের কাছে। তারপর হয়তো ধীরে ধীরে সোমনাথের কথা ভূলে প্রাত্যহিক জীবনের ছন্দে ফেরেন সোমনাথের পরিবার। তবে ঘটনার মোড় নেয় দিন কয়েক আগে। পুরুলিয়ার নিমতাড়া গ্রামের বাসিন্দা, প্রণব মাঝি, যার শ্বশুর বাড়ি বাঁকুড়ার সিমলাপালে।
তিনি মধ্য প্রদেশের গঞ্জোবাসদা রেলওয়ে স্টেশনে কর্মরত। ওই স্টেশনের পাশের সরাই স্টেশনে অজানা অচেনা এক ব্যক্তি দু তিন দিন বসে থাকতে থেকে রেলের কর্মীরা। সরাই স্টেশনে লোক জনের যাতায়াত খুব কম ওই স্টেশনের ভৌগলিক অবস্থানের কারনে। স্বাভাবিক ভাবেই বেশ ফাঁকা ফাঁকা থাকে ওই স্টেশন চত্ত্বর। কিন্তু সেখানে ওই অপরিচিত ব্যক্তিকে এই ভাবে বসে থাকতে দেখে সন্দেহ দানা বাঁধে রেলের কর্মীদের। তারা কথা বলার চেষ্টা করেন অপরিচিত ব্যক্তি সোমনাথ মন্ডলের সাথে। কিন্তু সোমনাথ বাবু বাঙালায় কথা বলায় তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তারা তখন ফোন করেন পাশের স্টেশনে কর্মরত পুরুলিয়ার নিমতাড়া বাসিন্দা প্রণব মাজির সাথে। প্রণব বাবু সরাই স্টেশনে গিয়ে তার সাথে কথা বলে পরিচয় জানার চেষ্টা করেন। তখন ওই মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি তার বাড়ির ঠিকানা হিসাবে সারেঙ্গা ও বামনীশোল গ্রামের নাম বলে। এরপর প্রণব বাবু ফোন করেন তার শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় তুষার পালকে। তিনি তাকে ফোনে পুরো বিষয়টি বলেন এবং কয়েকটি ছবি পাঠান।
তুষার বাবু তার বন্ধু সিমলাপাল ব্লকের বাসিন্দা যাদব মুখার্জিকে ২০ এপ্রিল ফোন করে ব্যাপারটি জানায়। যাদব সোমনাথ মন্ডলের ছবি এবং পুরো ঘটনাটি তুলে ধরে সমাজ মাধ্যমে তার নিজের একাউন্টে পোস্ট করে। পাশাপাশি সেই তথ্য সে শেয়ার করে সারেঙ্গা ব্লকের বেশ কিছু মানুষের মোবাইলে। সেই পোস্ট দেখে অনেকেই খবর দেন বামনীশোল গ্রামে সোমনাথ মন্ডলের পরিবারের সাথে। সোমনাথ বাবুর ছবি দেখে তাকে চিনতে পারেন তার বাড়ির সদস্যরা। তারা যেন মন থেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তবে এরপর সোমনাথ বাবুর ছেলে রাহুল যোগাযোগ করে যাদব মুখার্জি ও তুষার পাল এর সাথে। সেখান থেকে ফোন নম্বর নিয়ে মধ্য প্রদেশে কর্মরত সিমলাপালের জামাই প্রণব মাঝির সাথে যোগাযোগ করেন। তাকে সোমনাথ বাবুর ছেলে জানান, তার বাবার মাথায় কাটা দাগ এবং ডান হাতে ট্যাটুতে তার নাম লেখা আছে। সেটা জানার পর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে একটি আশ্রমে নিয়ে গিয়ে সাবান মাখিয়ে স্নান করানো হয়। কেটে ফেলা হয় দীর্ঘদিনের চুল দাঁড়ি। বেরিয়ে আসে মাথার কাটা দাগ, আর হাতের সোমনাথ লেখা। মিটে সন্দেহের অবকাশ। দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর পরিবারের হারানো ছেলেকে এই ভাবে ফিরে পাবেন হয়তো ভাবেন নি কেউ। পরিবারের সদস্যদের চোখে তখন আনন্দ অশ্রু। এরপর পরিবারের পক্ষ থেকে সোমনাথকে দ্রুত বাড়িতে ফিরিয়ে আনার প্রস্তুতি শুরু হয়।
সারেঙ্গা থেকে মধ্য প্রদেশ এর উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা দেন সোমনাথ মন্ডলের বামনীশোলের পরিবারের সদস্যরা। প্রশাসনিক কাজ সেরে হারিয়ে যাওয়া সোমনাথকে নিয়ে ট্রেনে চড়ে বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা দেন হারিয়ে পরিবারের সদস্যরা। বাড়ি পৌঁছাতেই খুশির জোয়ার সোমনাথের পরিবারে। বাড়ি ফিরে নিজের ছেলেকে বসালেন কোলে। স্ত্রীকে জানিয়েছেন “আমি আছি”। আনন্দে কেঁদে ফেললেন সোমনাথ বাবুর স্ত্রী। বাবাকে ফিরে পেতে যারা সাহায্য করেছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানান সোমনাথ বাবুর ছেলে রাহুল মন্ডল। আজ থেকে চোদ্দ বছর আগে বাবার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কাহিনী শোনালেন তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া সোমনাথ বাবুর মেয়ে।