ভোটযুদ্ধ ২০২৪-বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্র।
বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুরঃ- ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের যে ৪২ টি আসনে ভোট হতে যাচ্ছে তাতে অন্যতম নজরকাড়া কেন্দ্র বালুরঘাট। বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের জন্য ভোট নেওয়া হবে ২৬ এপ্রিল।
মূলত দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর মধ্যে এই লড়াই সংঘটিত হতে যাচ্ছে। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এখানে বর্ষিয়ান রাজনীতিক তথা রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রী বিপ্লব মিত্রকে প্রার্থী করেছে। অন্যদিকে বিজেপি এখানে প্রার্থী করেছে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্র থেকে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের জয়ী প্রার্থী তথা রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে এখান থেকে সুকান্ত মজুমদার ৩৩,২৯৩ ভোটের ব্যবধানে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী টিএমসি প্রার্থী অর্পিতা ঘোষ কে পরাস্ত করেছিলেন। এবার নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী বদল করেছে। অন্যদিকে এখানে বামফ্রন্ট মনোনীত আরএসপি প্রার্থী জয়দেব সিদ্ধান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
রাজনীতির কারবারিদের মতে এই নির্বাচন মূলত হতে যাচ্ছে বিপ্লব মিত্র ও সুকান্ত মজুমদারের মধ্যে লড়াই। নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই এই দুই প্রার্থী জোর কদমে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে রয়েছে ৭ টি বিধানসভা কেন্দ্র। এদের মধ্যে বালুরঘাট, গঙ্গারামপুর, তপন, হরিরামপুর কুমারগঞ্জ এবং কুশমন্ডি দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত। আর ইটাহার বিধানসভা কেন্দ্রটি উত্তর দিনাজপুরের অধীন।
সুকান্ত মজুমদার গত লোকসভা নির্বাচনে ৫,৩৯,৩১৭ ভোট পেয়েছিলেন অর্থাৎ মোট ভোটের শতকরা ৪৫% এবং অর্পিতা ঘোষ পেয়েছিলেন ৫,০৬,০২৪ টি ভোট অর্থাৎ মোট ভোটের শতকরা ৪২.২%। এর অনেক পিছনে বামফ্রন্ট প্রার্থী রনেন বর্মন ৭২,৯৯০ ভোট পেয়েছিলেন অর্থাৎ মোট ভোটের শতকরা ৬.১%। মজুমদার এবং মিত্রের ভোটের মার্জিন ছিল মাত্র ২.৮%।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের শতাংশের বিচারে ভোট পেয়েছিল ৪৭.২%।অপরদিকে বিজেপি শতাংশের বিচারে ভোট পেয়েছিল ৪৩%। অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে শতাংশের বিচারে ভোট বেড়েছিল ৪.২%। টিএমসি প্রার্থী বিপ্লব মিত্র যদি এই ভোট বাড়ার ব্যবধান ধরে রাখতে পারেন তাহলে নিঃসন্দেহে তা সুকান্ত মজুমদারের কাছে রীতিমত চিন্তার কারণ হবে।
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে ছ’টি বিধানসভা ক্ষেত্রে টিএমসি মোট ভোট পেয়েছিল ৫,০১,৪১৮। আর বিজেপি পেয়েছিল ৪,৫৬,৪৭৩ টি ভোট (এর মধ্যে অবশ্য ইটাহার বিধানসভা ক্ষেত্রটি ধরা হয়নি)। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে কুশমন্ডি, কুমারগঞ্জ এবং হরিরামপুর থেকে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীরা জিতেছিলেন। অপরদিকে বালুরঘাট, তপন এবং গঙ্গারামপুর আসন থেকে বিজেপি প্রার্থীরা জিতেছিলেন। এর মধ্যে তপন এবং গঙ্গারামপুরে শতাংশের বিচারে বিজেপির পক্ষে ভোট জেতার মার্জিন ছিল যথাক্রমে মাত্র ০.৯% এবং ২.৪%। অপরদিকে কুমারগঞ্জ এবং হরিরামপুরে শতাংশের বিচারে টিএমসির পক্ষে ভোট জেতার মার্জিন ছিল যথাক্রমে ১৭.৩% এবং ১২.২%। শতাংশের বিচারে কুশমন্ডিতে টিএমসি প্রার্থীর ভোট জেতার মার্জিন ছিল ৬.৯% আর বালুরঘাটে বিজেপির পক্ষে এই ভোট জেতার মার্জিন ছিল ৮.৯%।
এবারে লোকসভা নির্বাচনে মূল ইস্যু হতে যাচ্ছে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন, কল-কারখানা নির্মাণ, রেল-যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ১০০ দিনের কাজের টাকা, বেকার সমস্যার সমাধান এবং জেলার সামগ্রিক উন্নয়নে কেন্দ্রের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে আসার বিষয়টি।
বিপ্লব মিত্র তার প্রচারে গিয়ে বলছেন, “বালুরঘাটের সাংসদ গত পাঁচ বছরে জেলার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অনেক সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রায় কিছুই করেননি। জেলায় কেন্দ্র সরকারের হাত ধরে শিল্প স্থাপন হতে পারতো বা বেকার সমস্যার সমাধান হতে পারতো। এই কাজগুলোর কিছুই হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার বাংলার উন্নয়নের জন্য তার প্রাপ্য টাকা বন্ধ করে দিয়েছে। ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে রেখেছে। আমাদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার এই টাকা গরিব মানুষদের ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস এইরকম একজন কাজের নিরিখে শূন্য পাওয়া সাংসদকে জনগণ আর ভোট দিয়ে জেতাবে না।”
মিত্র বলেন, “সুকান্ত মজুমদার ভোটারদের কাছে রেল আনার কথা বলছেন কিন্তু বাস্তবটা হলো বালুরঘাট থেকে যে ট্রেনটা গৌড়লিংক এক্সপ্রেস নামে মালদা হয়ে কলকাতা যেত সেই ট্রেনটা বাতিল করে বর্তমান সাংসদ শিয়ালদা থেকে বালুরঘাট পর্যন্ত একটা ট্রেন দিয়েছেন। তাহলে কি হল? একটা ট্রেন বাতিল হয়ে আরেকটা ট্রেন হল। এতে সমস্যার সমাধান কিছুই হলো না। অপরদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে জেলায় রেল এসেছে। তিনি সাংসদ থাকাকালীন দলের রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের হাত ধরে বুনিয়াদপুরে রেলওয়ে ওয়াগন ফ্যাক্টরি করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ওখানে ওয়াগন ফ্যাক্টরি হলে অনেক বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান হত। এখন আমরা শুনতে পাচ্ছি ওখানে নাকি স্টেডিয়াম হবে। স্টেডিয়াম হলে ওখানে কোনো কর্মসংস্থান হবে না। ওখানে স্টেডিয়াম হলে সাধারণ লোকের কোন উপকার হবে না।”
অন্যদিকে সুকান্ত মজুমদার তার প্রচারে বলছেন, “বালুরঘাটের সাংসদ হিসেবে আমি জেলার উন্নয়নে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বালুরঘাট স্টেশন অমৃত ভারত স্টেশনের আওতায় এসেছে।অমৃত ভারত স্টেশন হলে বালুরঘাট স্টেশনের প্রভূত উন্নতি হবে। তাছাড়া রেলমন্ত্রকে বলে আমি বালুরঘাট-শিয়ালদা নতুন ট্রেনের উদ্বোধন করিয়েছি। ইতিমধ্যে বালুরঘাট থেকে দিল্লি যাওয়ার ট্রেনের রেলমন্ত্রকের তরফ থেকে নোটিফিকেশন জারি হয়েছে। খুব শীঘ্রই বালুরঘাট থেকে দিল্লি যাওয়ার ট্রেন চালু হবে। গঙ্গারামপুরের অধীনস্থ বাণগড় ঐতিহাসিক স্থানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তরফ থেকে পর্যটন শিল্পের জন্য এখানকার উন্নয়নে ২.৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। খুব শীঘ্রই সেখানে কাজ শুরু হবে। আমি যদি সাংসদ হিসেবে জিতি তাহলে জেলার সামগ্রিক উন্নয়নে এরকম অনেক কাজ করব।”
মজুমদার বলেন, “আসলে রাজ্যে টিএমসির নেতা-মন্ত্রীরা দুর্নীতির সাথে যুক্ত। বহু নেতা-মন্ত্রীরা ইডি এবং সিবিআই হেফাজতে রয়েছেন। আমি আশা করব দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা মন্ত্রীদের আগামী লোকসভা নির্বাচনে বাংলার সাধারণ ভোটারেরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেনা।”
বামফ্রন্ট প্রার্থী জয়দেব সিদ্ধান্ত ভোটারদের মধ্যে গিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিরুদ্ধে বিষদগার করছেন এবং বলছেন, “কেন্দ্র এবং রাজ্য জেলা তথা রাজ্যের উন্নয়নে সার্বিকভাবে ব্যর্থ। তাদের কাছে একমাত্র বিকল্প বামফ্রন্ট। আমি আশা করছি এবারের ভোটে জনগণ আমাকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন।”
সুতরাং সব মিলিয়ে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্র আগামী ২৬ এপ্রিল যখন এ কেন্দ্রের জন্য ভোট গ্রহণ হবে তখন নিঃসন্দেহে সারা রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলির মধ্যে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ভোটারদের কাছে বিবেচিত হবে।